ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত, কার্যালয়ে রহস্যজনক আগুন

রেলের জায়গা অবৈধ ভাবে দখলের চেষ্টা চট্টগ্রাম ওয়াসার

Passenger Voice    |    ০৩:০৩ পিএম, ২০২০-১০-১২


রেলের জায়গা অবৈধ ভাবে দখলের চেষ্টা চট্টগ্রাম ওয়াসার

নিজস্ব প্রতিবেদক: একে একে পুর্ননিয়োগ পেয়েছেন ছয়বার। সাকল্যে ৯ বছর। এত বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে আছেন এ কে এম  ফজলুল্লাহ। ৭৮ বছর বয়সী চৌকস এই কর্মকর্তাকে আরও তিন বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একেএম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে হাসান আলী নামের এক গ্রাহক হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। এর প্রেক্ষিতে এমডির অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

এদিকে বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টে রিট হওয়ার পর রিটের আদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াসা অফিসের তৃতীয় তলায় রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে। নগরবাসির অভিযোগ সুষ্ঠ তদন্ত বিঘœ ঘটানোর জন্য ফিল্মি স্টাইলে পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগানো হয়েছে। তাছাড়া গত বছর নিরাপদ পানির প্রশিক্ষণে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উগান্ডা যাওয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। এমন ডজনখানেক অভিযোগ থাকার পর এবার ৭৮ বছর বয়সে এসে বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার পায়তারা করছে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ এমন অভিযোগ রেলের শীর্ষ কর্তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে হাতে নেওয়া তিন হাজার কোটি টাকার স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে জোড় পূর্বক অবৈধ ভাবে রেলের জায়গা দখল করতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা। অনেকে বলছে প্রকল্পের কাজ হলে ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাট ও অপচয় করার সুযোগ পাবে, নিজেদের পকেট ভারি করতে রেলকে কুক্ষিগত করছে এই  কুচক্রি মহল। ওয়াসার অবৈধ দলখের জায়গায় ভবিষ্যতে রেল লাইন পুনঃস্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। চট্টগ্রাম ওয়াসার এই প্রকল্পটি জনগুরুত্বপূর্ণ তৈরি করতে জোড় তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। অসাধু কর্মকর্তারা মূখে উন্নয়নের ডেকুর তুললেও প্রকল্প বাস্তবায়নে চলবে দুর্নীতির হরিলুট।

আরো পড়ুন>>>> অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রেল পানির টেন্ডার হাতিয়ে নিল শ্যামলী পরিবহন

সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে তিন হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি স্যুয়ারেজ প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা যা ২০২৩ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে দীর্ঘ সময় পার হলেও  এই  প্রকল্পের জন্য এখনও কোন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পারেনি ওয়াসা। এই  প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ৩ হাজার ৭৫৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বহন করলেও ৫০ কোটি টাকা অর্থায়ন করার কথা রয়েছে ওয়াসার। 

মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশ অনুসারে চট্টগ্রাম ওয়াসা ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় নগরীর হালিশহর এলাকায় প্রতিদিন এক লাখ ঘনমিটার ধারণক্ষমতার পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজে  ওয়াসা যে জায়গায় আরসিসি পিলার স্থাপন করছে সেটা রেলের অধিগ্রহণকৃত জায়গা। অধিগ্রহণ করার পর সেখানে রেল লাইনও স্থাপন করা হয়েছিল, যা এখন সামান্য বিলুপ্ত।

রেল সূত্র বলছে, চলতি বছরের মার্চে রেলওয়ের ভু সম্পত্তি বিভাগের আমিন কানুঙ্গরা ফৌজদারহাট-স্টিল মিল সাইডিং লাইনের উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজার জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন  করতে গিয়ে দেখে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃক আরসিসি পিলার দ্বারা দেওয়াল নির্মাণের মাধ্যমে রেল লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। রেলের দাবী ১৯৬৫-৬৬ সালের চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখার ৯৯/৬৫-৬৬ নং মামলা মূলে উত্তর হালিশহর সিট নং ০৮, জে এল নং ০৯, বি এস দাগ নং ৬৫০১,৬৫০২ ও ৬৫০৩ খতিয়ান নং ০২ জায়গাটি বাংলাদেশ রেলওয়ে অধিগ্রহণ করে। তবে এই জায়গার পাশে চট্টগ্রাম ওয়াসার কিছু নিজস্ব জায়গাও রয়েছে। তারা নিজস্ব জায়গায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এর স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার নামে পাশে থাকা রেলের সাড়ে ৮ একর জায়গাও ওয়াসা অবৈধ ভাবে দখলে নিয়েছে।  

আরো পড়ুন>>>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভু সম্পত্তি বিভাগের সূত্র বলছে,  রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত মোট ৪১.৭৫২ একর ভূমির মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে ৮.৬৫৬ একর ভূমি রেলওয়ের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় এবং সেই ভূমির উপর গ্যাং কোয়ার্টার নির্মাণ এবং রেল লাইন স্থাপন করে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ রেলওযয়ে তৎকালীন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের অনুকূলে এল এ কেইস নং ৯৯/৬৫-৬৬ মূলে উত্তর,মধ্য ও দক্ষিণ হালিশহর মৌজার আর এস জরিপ অনুযায়ী উত্তর হালিশহর মৌজায় এলএডিসি/চট্টগ্রাম হতে ৪.১৭৫ একর ও ওয়াসা হতে ০.৪০৪ একর, মধ্য হালিশহর মৌজায় ওয়াসা হতে ৮.২৫২ একর ও এলএডিসি/ চট্টগ্রাম ১১.৫৯৭ একর, দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় এলএডিসি/চট্টগ্রাম হতে ১৭.১৯৮ একর এবং এমইএস হতে ০.১২৫ একর সহ সর্বমোট ৪১.৭৫২ একর জমি রেলওয়ের নামে অধিগ্রহণ করা হয়। এই ভূমির মধ্যে উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজার বি এস খতিয়ান নং ০২, বি এস দাগ নং ৬৪৫৫,৬৪৫৬,৬৫০১,৬৫০২,৬৫০৩,৫৩৩৩,৫৩৩৪,৩৯২৫,৩৫৬১,৩৯২৬,৩০১/৩৯৩৫,৭০৩৮,৭০৩৯,৭০৫৫,৭০৫৬,৭০৫৭,৭০৫৮,২৩৬৫,২৩৬৭,১০৯/৯৭৯,৪২১৭,৪২১৮,৪২২০,৯২৬৬,৯২৬৭,৯২৬৮,৯২৬৯,৯২৭০,৯২৭১,৯২৭২,৯১৭৩,৯২৭৪,৯২৭৫,৯২৭৬ যা বাংলাদেশ রেলওয়েরর নামে খতিয়ানে শুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার সার্ভেয়ার, কানুঙ্গ ও এস্টেট কর্মকর্তারা জানান বিলুপ্ত রেল লাইনসহ আশপাশের ভূমি এল এ কেইস নং ২২৫/৬২-৬৩ এর মাধ্যমে ১৬৩.৮৫৫ একর ভূমি চট্টগ্রাম ওয়াসা অধিগ্রহণ করেছে।

রেলওয়ে সূত্র আরো বলছে, ফৌজদারহাট থেকে স্টিল মিল সাইডিং লাইনের উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজায় বাংলাদেশ রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমি রয়েছে। যেহেতু রেলভূমিটি রেলওয়ের রাইট অফ ওয়ে এর উপর অবস্থিত যাতে রেলওয়ের প্রয়োজনে ভবিষ্যতে রেললাইন পুনঃস্থাপনে জমিটি প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সমুদ্রপথে বিদেশ হতে আমদানীকৃত খাদ্যশস্য, পণ্য ও মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর হতে জাহাজ খালাসে আনলোডিং পরবর্তীতে কনটেইনার ও পণ্যবাহী রেলযোগগে সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড এর মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশ এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পরিবহনের আঞ্চলিক এবং উপ আঞ্চলিক করিডোর হিসেবেও সমধিক  খ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক করিডোর হিসেবেও বর্তমানে বিবেচনা করা হয়।

এছাড়া পদ্মা,যমুনা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির তেলের ওয়াগণ ইশাঁ খাঁ নৌঘাঁটির মধ্য দিয়ে চলমান রেল লাইন ব্যাবহার করা হয়। নৌঘাঁটির অভ্যন্তরে রেল লাইনের ওপর নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তাজনিত কারণে আপত্তি রয়েছে তাই বিকল্প হিসেবে স্টিলমিল সাইডিং লাইন (আনন্দবাজার) চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এবস্থায় রেল লাইন চালু হওয়ার কথা থাকায় রেলভূমী সুরক্ষার স্বার্থে রেলওয়ের কোয়ার্টার সহ অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির সীমানা অক্ষুন্ন রাখতে রেলওয়ে ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মধ্যে বেশ কয়েকটি চিঠি চালাচালি হলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অসহায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা ক্ষমতার দাপটে  অবৈধভাবে জোরপূর্বক রেল ভূমিতে আরসিসি পিলার দিয়ে ওয়াল নির্মাণ কাজ করছে।  

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের বিভাগীয় ভূ সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবুল করিম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা উন্নয়ন মূলক কোন কাজে বাধা দিতে চাই না। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ওয়াসা যদি এই জমি প্রয়োজন মনে করে তাহলে সেটা সঠিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে আন্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক সিদ্ধানের মাধ্যমে গ্রহন করতে পারে। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার শাহাদাত আলি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা ও বাংলাদেশ রেলওয়ে দুইটিই সরকারি সংস্থা। আমরা চাই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দ্রুতই ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসবো। পরবর্তীতে কি হয় সকলেই জানতে পারবেন। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়: নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (চট্টগ্রাম ওয়াসা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, রেলওয়ে যেটা বলছে তা সত্য নয়। ৩০-৪০ বছর আগে এই জমি রেলকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল। তখন তারা সেখানে রেল লাইন স্থাপন করেছিল, তবে ব্যবহারের জন্য আমরা রেলকে শর্তে বলেছিলাম এই জমিতে রেল লাইন ব্যতীত অন্য কোন কাজ করতে পারবেনা। তবে রেলওয়ে সেই শর্ত ভঙ্গ করেছে তাই ব্যবহারের জন্য যেই চুক্তি করা হয়েছিল তা এখন বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।